11111

আমরা চাইলেই তো আমাদের ক্যারিয়ারের ঊচ্চতা ধরে রাখতে পারি

পর্ব ১: ছোট বেলায় সবার মতো আমারও সখ ছিলো গ্যাস বেলুন কিনে কিছুক্ষণ খেলে আকাশে ঊড়িয়ে দেয়া। ঊড়াবার পর তাকিয়ে থাকতাম যতক্ষণ না পর্যন্তু ওটা দৃষ্টি সীমানার বাইরে না যায়। একসময় দেখতাম সেটা আর দেখা যাচ্ছে না। বাবাকে জিজ্ঞেস করতাম বেলুনটা গেল কই। বাবা বলতেন আকাশ নিয়ে গেছে। মন খারাপ হতো কিন্তু কিছুক্ষণ পর অন্য কিছুতে আবার মজে যেতাম। কিন্তু মনের প্রশ্ন রয়ে যেত আসলেই কি আকাশ নিয়ে যায়, যদি নিয়ে যায় তাহলে কেন নিয়ে যায়। প্রশ্নের ঊত্তর পাই না। এভাবেই সময় পেড়িয়ে বড় হই আর বুঝতে শিখি। বড় হবার অনেক পরে জানতে পারি বেলুনটির ভেতরের গ্যাস একটা নির্দৃষ্ট ঊচ্চতায় যাওয়ার পর আর বেলনকে ঊপরের দিকে নিতে পারে না। তখন সেটা হয় নিম্নগামী এবং একসময় মাটিতে চলে আসে। এর একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও পরে জানতে পারি যেটা নিয়ে আর এখানে লিখলাম না। আপনারা Google কে (How far can a helium filled balloon travel?) প্রশ্ন করে জেনে নিতে পারবেন।

পর্ব ২: আমরা আমাদের জ্ঞান, বুদ্ধি, শিক্ষা ব্যবহার করে সুযোগের সন্ধান করি এবং লক্ষ্য স্থির থাকার কারনে আমরা সঠিক সময়ে সুযোগের দেখাও পেয়ে যাই। একের পর এক ভালো কাজ করতে থাকি এবং সুভানুদ্ধায়িদের প্রশংসার জোয়ারে ভাসতে থাকি। বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রশংসা আসতে থাকে। প্রশংসার ঊর্দ্ধমুখী চাপে আমরা ঊপরের দিকে যেতে থাকি। প্রথমদিকে আমরা বিনয়ীভাব রেখে আমরা প্রশংসার জবাব দেই। ধীরে ধীরে আমাদের মধ্য থেকে বুদ্ধির অভাব দেখা দেয়। একসময় আমাদের মধ্যে অহংকারের মতো বিষ আমাদের মনের মধ্যে জন্ম নেয়। আমরা সবকিছুই নিজের একার মনে করি এবং ধীরে ধীরে আমাদের জবাবে, চলনে চলে আসে ভিন্নতা। আমরা আমাদের চলার পথের সাথিদের মাঝে ক্যাটাগরি করে ফেলি। আমরা একধরনের আত্মগর্ভে নিমোজ্জিত হতে থাকি। আমরা আমাদের জ্ঞানের সঠিক ব্যবহারে ভুল করে ফেলি।অহংকারে ডুবে থাকার করনে অর্জিত শিক্ষাকে আর বাড়াতে পারি না। একসময় যে জ্ঞান, বুদ্ধি এবং শিক্ষা নিয়ে আমরা ঊপরের দিকে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ আমাদের অজ্ঞতার কারনে আমরা নিচের দিকে পড়ে যেতে থাকি। তখন আর আমাদের ধরে রাখার জন্য কাঊকে পাশে পাইনা। ইচ্ছা থাকলেও কেঊ ধরবে না কারন ইংরেজীতে একটি প্রবাদ আছে “Never try to catch Falling Stone”, নিচের দিকে পড়তে থাকা পাথর ধরতে গেলেই বিপদ।

পর্ব ১ ছিল গ্যাস বেলুন নিয়ে আর পর্ব ২ এ বলেছি মানুষ নিয়ে। দুই পর্বেই দ্রুতার সাথে ঊপরের দিকে ওঠা এবং এবং একই গতিতে নিচের দিকে নেমে আসা। কিন্তু একটা তফাত আছে এখানে। গ্যাস বেলুন চাইলেও আর ঊপরে ঊঠতে পারবে না কিন্তু মানুষ চাইলে সে কখনও নীচে পড়বে না।

আমরা ঊন্নতির চরমে পৌছে নিচে পড়ে যাই কেন? আমার মতে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের অহংকার, আত্মঅহমিকা নামক বিষ থেকে। আর এগুলোর জন্ম হয় প্রশংসা, সাফল্য, সম্মান ইত্যাদি প্রাপ্তিতে। খুব সহজেই এই বিষ থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি। যখনই কোন প্রশংসা, সম্মান বা কোন অর্জন সামনে আসবে আমরা মনে মনে বলতে পারি সকল প্রশংসা, সকল সম্মান আমার সৃষ্টিকর্তার। যদি আমরা আমাদের অর্জিত সকল প্রশংসা, সম্মান আমাদের সৃষ্টিকর্তাকে ঊৎসর্গ করি তাহলে একধরনের ভারমুক্ত অনুভব করবো। মানুষের পক্ষে আসলে এই ভার বহনকরা অসম্ভব। বেলুনের পক্ষে ঊর্ধগামীতা ধরে রাখার কোন ঊপায় নেই কারন সে জড় বস্তু কিন্তু আমরা পারি কারন আমরা সৃষ্টির সেরা। অহংকার থেকে দুরে থাকতে পারলেই তো “Sky is the Limit”

33333333333

টেকসই সমাজ গড়তে হলে প্রয়োজন প্রশ্ন করার অভ্যাস

আরিয়ান যখন খুব ছোট মাত্র ৪ বা ৫ বছর বয়স। কোন এক বিষয়ের আলোচনায় সে একটি প্রশ্ন করেছিল। তার প্রশ্নের ধরন দেখে তার পরিবারের সবাই হাততালি দিয়ে বাহবা দিয়েছিল। মা তাকে প্রায়ই বলতো তুমি ছোটবেলায় এতো প্রশ্ন করতে, এতো তোমার জানার আগ্রহ ছিল। যখন আরিয়ান একটু বড় হলো, স্কুলে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতো আর হাসিমুখে উত্তর পেতো। প্রাইমারি পর্যন্ত এরকম চলল। যখন মাধ্যমিকে উঠলো, শুরু হলো অন্য একধরনের অভিজ্ঞতা। প্রশ্ন করাই যেন অপরাধ। বাসায় প্রশ্ন করলে বলা হয় বড়দের মাঝে প্রশ্ন করা বেয়াদবির সামীল। স্কুলে শিক্ষকের আলোচনা শুনে কোন কিছু জানার আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলে শিক্ষকের ধমক খাওয়া অনিবার্য। বাসায় কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে আগে থেকেই বলা হতো একদম চুপচাপ করে বসে থাকবে, কোন প্রকার প্রশ্ন করা চলবে না। স্কুলের অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একই ধারা। প্রধান শিক্ষকের কড়া নির্দেশ, কোন প্রকার পশ্ন করা যাবে না। একদম মুখবন্ধ করে বসে থাকতে হবে রোবটের মতো। মাধ্যমিকে শুরু হওয়া প্রশ্ন না করার শর্ত চলমান থাকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পর্যন্ত। আরিয়ানের মনে আজ খুশির জোয়ার বইছে। কারন বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে আজ সে কর্মজীবন শুরু করতে যাচ্ছে। কর্মজীবনের এক সপ্তাহ ভালোই কাটলো। একসপ্তাহ পর সে তার সেই চিরচেনা ধাক্কাটি খেলো। কোন এক মিটিংয়ে আরিয়ান তার শৈশব সুলভ আচরন করলো, মানে একাধিক প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে ফেলল। মিটিং শেষে বসের কামরায় ডাক পড়লো। এরপর তাকে যা বলা হলো সেগুলো শুনে তার সেই মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কথাই মনে পড়ে গেল। নির্মম সত্য হচ্ছে এটা শুধু আরিয়ানের গল্প নয়। এরকম হাজারো আরিয়ানের গল্প ছড়িয়ে আছে পথে ঘাটে।

চীনা প্রবাদ প্রচলিত আছে “যিনি প্রশ্ন করেন তিনি পাঁচ মিনিটের জন্য বোকা থাকেন; আর যিনি প্রশ্ন করেন না তিনি চিরদিনের জন্য বোকা থাকেন “। আমরা যদি উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো শিশুবয়স থেকে তাদের বাচ্চাদের শেখানো হয় কিভাবে প্রশ্ন করতে হয়। ভালো প্রশ্ন করলে রিতিমতো বাহাবা। ভুল প্রশ্ন করা হলে এমনভাবে শুধরে দেওয়া হয় যাতে ভবিষ্যতে লজ্জাবোধ করে প্রশ্ন করা বন্ধ করে না দেয়। তাইতো উন্নত দেশের উদ্ভাবকেরা তাদের উদ্ভাবিত ধারনা শিশুদের সাথে শেয়ার করেন। তারা উভয়ই প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে শেখার চেষ্টা করেন। শেখার সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকর উপায় হচ্ছে প্রশ্ন করা। ছোটবেলায় আমরা হাজারো প্রশ্নের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করেছি কিন্তু যত আমাদের বয়স বেড়েছে তত আমরা লজ্জবোধ থেকেই হোক আর সমাজ ব্যবস্থার কারনেই হোক, প্রশ্ন করা ভুলে গেছি। প্রশ্ন করার ব্যাপারে আমাদের যতটা গুরুত্ব দেওয়া দরকার আমরা সেটা দিচ্ছি না। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি চোট-বড় কোম্পানি কোথাও প্রশ্ন করার উপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না । একটা থিওরি প্রচলিত আছে যে যদি টেকসই সমাজ গড়তে চাও তাহলে শতকরা ৮০% সময় ব্যয় করো প্রশ্ন-উত্তরে আর বাকি ২০% ব্যয় করো গড়তে।

পৃথিবীতে বর্তমানে আমাদের সামনে যা কিছু আছে সবই হয়েছে কারো না কারো প্রশ্ন করার কারনে। নিউটন যদি আপেলটি পরার পর প্রশ্ন না করে খেয়ে ফেলতেন, তাহলে কি হতো? “উদ্ভাবনী চিন্তাবিদদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস হচ্ছে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা”, কথাটি বলেছেন উদ্ভাবনের উপর যুক্তরাজ্যের শীর্ষস্থানিয় বক্তা পল স্লোণি। বাংলাদেশের অত্যন্ত গুণি একজন শিক্ষাবিদ ডঃ ইউসুফ এম ইসলাম তার প্রশ্নের প্রয়োজনীয়তা শীর্ষক একটি প্রবন্ধে উল্ল্যেখ করেছেন একজন মানুষ লিখতে পড়তে না পারলেও জ্ঞান অর্জনে কোন সমস্যা হবে না যদি সে প্রশ্ন করার অভ্যাস সাথে নিয়ে চলতে পারে।

একটি বিষয় খুব সহজেই উপলব্ধি করা যায় আর সেটা হলো জীবনের নিদৃষ্ট গন্তব্যে পৌছতে হলে প্রশ্ন জিজ্ঞাসার বিকল্প কিছু নেই। এখন আসি প্রশ্ন করার অন্তর্নিহিত উপকারিতা গুলো কি?

• প্রশ্ন করার মাধ্যমেই আমরা জীবন সম্পর্কে জানতে পারি এবং এটা বৈজ্ঞানিক ভাবেও প্রমাণিত। শিশুরা সাধারণত বিশ্ব সম্পর্কে শিখতে শুরু করে শুধুমাত্র একটি প্রশ্ন করে আর সেটা হলো ”কেন”।

• আমরা যত বেশি প্রশ্ন করবো, তত দ্রুত ভালো উত্তর পেয়ে যাবো। শিশুকালে আমরা তাই করেছি কিন্তু দুঃখের বিষয় বয়স বারার সাথে সাথে আমরা ”কেন” এবং এর উত্তরের জন্য অপেক্ষা করা ভুলে গেছি।

• আমাদের জীবনের গুণগতমান নির্ভর করে প্রশ্নের উপর কারন আমাদের চিন্তাভাবনার গুণগত মান নির্ভর করবে আমাদের প্রশ্নের গুণগত মানের উপর। আর আমাদের চিন্তাভাবনার গুণগতমান বৃদ্ধির উপর জীবনের মান নির্ভরশীল। আর প্রশ্ন করা ভুলে গেছি বলেই প্রশ্নের মান বৃদ্ধিও হচ্ছে না।

• প্রশ্ন করার অভ্যাস আমাদের উস্মুক্ত করে, উদারপন্থি করে।

• আমাদের জীবনকে সুখোময় করার একমাত্র উপায় হচ্ছে সঠিক সময়ে সঠিক প্রশ্ন।

আমাদের সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হলে, আমাদের যুব সমাজকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে হলে আমাদের প্রশ্ন করার উপর জোর দিতে হবে। আর সেটার শুরা এবং যত্ন শিশুবয়স থেকেই করতে হবে।

প্রশ্ন দুভাবে করা যায়। নেতিবাচক অর্থে আবার ইতিবাচক ভাবেও সম্ভব। আমাদের সকলেরই উচিত ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন করা। ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন করতে হলে দুটি বিষয় অত্যন্ত জরুরী একটি হলো জানার আগ্রহ এবং অপরটি হলো শোনার আগ্রহ। আর এইদুটি বিষয়কে মাথায় রেখে আমরা যখন প্রশ্ন করবো তখন যেকোন সৃষ্টি আমাদের জন্য সহজ এবং দ্রুত হবে।