সুইডিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা (সিডা) আয়োজিত উচ্চশিক্ষার স্থায়ী উন্নয়ন বিষয়ক এক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে সুযোগ হয়েছিল সুইডেনের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে অংশগ্রহণ করার। এছাড়াও উপসালা এবং চালমার বিশ্ববিদ্যালয়ও সফর করা হয়েছে।
সম্মেলনে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে যখনই যাওয়া হয় তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীষ্মকালীন সেমিস্টার শেষ এবং নতুন সেমিস্টারের প্রস্তুতি চলছে। তাই ধারণা করেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো বন্ধ থাকবে। কিন্তু আমার ধারণা ভুল। ক্যাম্পাসে ঢ়ুকেই আমি দেখতে পেলাম সরগরম অবস্থা। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
প্রথমদিন বুঝতে পারিনি। দ্বিতিয়দিন দেখলাম সম্পূর্ণ ভিন্নচিত্র। শিক্ষার্থীরা সবাই পরিপাটি হয়ে হাতে একটি ফোল্ডার নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, ক্যাম্পাস অডিটরিয়ামে ঢোকার অপেক্ষায়।
এক ছাত্রকে সামনে পেয়ে জিজ্ঞেস করতেই লাইনের কারণ জানা গেলো। বললো, চাকরি মেলা চলছে। বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি থেকে প্রায় দু’শতাধিক প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশগ্রহণ করছে।
অডিটরিয়ামে প্রবেশ করে আমার চোখ কপালে। কোম্পানির স্টলগুলো সারিসারি করে বসানো হয়েছে। ভাগ করা হয়েছে ইন্ডাস্ট্রিভেদে। শুধু কোম্পানির জন্য স্টলই নয়, আছে ইন্টারভিউ বুথ। যেখানে বিভিন্ন কোম্পানির কর্মকর্তারা সরাসরি ইন্টারভিউ নিতে পারবে। কোম্পানিগুলো তাদের চাকরি পদমর্যাদা এবং কাজের বিবরণী প্রতিটি স্টলে ঝুলিয়ে রেখেছেন। শিক্ষার্থীরা স্টলে স্টলে গিয়ে কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলছেন, জানার চেষ্টা করছেন কোম্পানি সম্পর্কে। একজন একজন করে ডাকা হচ্ছে, যেন এক উৎসবমুখর পরিবেশ।
ব্যাপারটা মোটেও এমন ছিল না যে হঠাৎ করে সবকিছু হয়ে গেল। পুরো বিষয়টি একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মধ্যে সম্পন্ন হয়। আর এর পেছনে কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার। পুরো বছর জুড়ে ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টারগুলো তাদের ছাত্রছাত্রীদের জন্য একাডেমিক পড়াশোনার শেষের দিকে চাকরি পাওয়ার প্রক্রিয়া এবং প্রস্তুতি দু’টোই একসঙ্গে চালিয়ে থাকে। বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাছাই করে তাদের কাছে ছাত্রছাত্রীদের তালিকা পাঠানো, প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তাদের চাকরি পদমর্যাদা, কাজের বিবরণী এবং সুবিধাগুলো সংগ্রহ করা, ছাত্রছাত্রীদের ইন্টারভিউর জন্য প্রস্তুত করা, সিভি তৈরিতে সহযোগিতা এবং সাজসজ্জার ধারণাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। ছাত্রছাত্রীরাও তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর বিষদ গবেষণার মাধ্যমে নিজেদের যোগ্য করে তুলতে সবসময় সচেষ্ট থাকে। তারপর আসে সেই কাঙ্ক্ষিত চাকরি মেলা।
কেন এই চাকরি মেলা?
চাকরি মেলায় চাকরিদাতা এবং সম্ভাব্য কর্মী, উভয়ের অংশগ্রহণের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিটি কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার পাশাপাশি আরেকটি বিষয় নিয়ে সবসময় চিন্তা করতে হয় আর তা হলো একটি ভালো চাকরি।
চাকরিদাতা এবং সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নেওয়া উভয়ের জন্য কর্মসংস্থানমূলক অনুষ্ঠানগুলো বিশেষ করে চাকরি মেলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর সেজন্য সারা বছর বিশ্বের বিভিন্নস্থানে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরাসরি নিয়োগ, অ্যাপ্লিকেশন এবং নেটওর্য়াকিং প্রসেসকে জোরদার করার জন্য চাকরি মেলার আয়োজন করে থাকে। চাকরিদাতা এবং সম্ভাব্য কর্মীদের জন্য চাকরি মেলা একধরনের অতি প্রয়োজনীয় মাধ্যম হিসেবে বিশ্বে পরিগণিত হয়।
কিন্তু আমাদের দেশে চাকরি মেলায় অংশগ্রহণে একধরনের অনিহা দেখা যায় চাকরিদাতা এবং চাকরি প্রার্থীদের মাঝে।
চাকরিদাতা এবং সম্ভাব্য কর্মী উভয়ের জন্য চাকরি মেলায় অংশগ্রহণের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো বিশাল নেটওর্য়াকের মাধ্যমে একজন আরেকজনকে সরাসরি যাচাই-বাছাই করার একটি সুযোগ পেয়ে থাকেন। চাকরি মেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে একজন চাকরি প্রত্যাশী নিমিষেই হাজার হাজার বায়োডাটার মধ্য থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারেন, আর যা কিনা শুথুমাত্র সম্ভব চাকরিদাতার সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে।
নিয়োগকর্তাদের জন্যও চাকরি মেলা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। মাত্র পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা অবস্থানের মাধ্যমে তারা একসঙ্গে শতাধিক কোয়ালিটি সিভি এবং সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে চাকরি প্রার্থীদের যাচাইয়ের প্রথম ধাপ সম্পন্ন করতে পারেন।
প্রতিষ্ঠানগুলোর চাকরি মেলায় অংশগ্রহণের উপকারিতা
একসঙ্গে এক জায়গায় একাধিক চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে প্রাথমিক যাচাই করা সম্ভব এবং অনেকক্ষেত্রে নিয়োগও সহজ করা যায়, চাকরি প্রত্যাশীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের ব্রান্ডের মান ও প্রচার এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা সম্ভব, সহজেই প্রতিভা খুঁজে পেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, গতানুগতিক বিজ্ঞাপন ব্যয় দূর করা সম্ভব এবং বিজ্ঞাপনের চেয়ে দ্রুত ট্যালেন্ট হান্ট করা যায়, কমিউনিটির সঙ্গে নেটওর্য়াক তৈরি করা সম্ভব হয়, একই মাধ্যমে সবধরনের যেমন ফুলটাইম, পার্টটাইম, ভলেনটারি পদের জন্য প্রার্থী যাচাই এবং সরাসরি নিয়োগ সম্ভব হয়।
ছাত্রছাত্রীদের চাকরি মেলায় অংশগ্রহণের উপকারিতা
নিয়োগকর্তারা কি চান তা সহজেই বোঝা যায়, নেটওয়ার্কিংয়ের বিশাল সুযোগ পাওয়া যায়, প্রতিষ্ঠান বা পুরো ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে রিসার্চ করা যায় যা পরবর্তীতে ইন্টারভিউতে কাজে লাগে, চাকরিদাতার কাছ থেকে সরাসরি ফিডব্যাক পাওয়া যায়, একসঙ্গে একাধিক প্রতিষ্ঠানে সিভি এবং সরাসরি ইন্টারভিউ দেওয়ার সুযোগ থাকে, মেলা পরবর্তী যোগাযোগের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
আমরা প্রায়ই লক্ষ্য করি ছাত্রছাত্রীরা চাকরি মেলায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে খুব একটা সচেতনতা প্রকাশ করে না। এমন কি প্রফেশনাল ইম্প্রেশনও তাদের মধ্যে দেখা যায় না।
তবে কয়েকটি পয়েন্ট মেনে চললে সরাসরি চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়
চাকরিমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা সংগ্রহ করে সে অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করা, কোন কোম্পানি কি কি পদের জন্য মেলায় অংশ নিয়েছে তার তালিকা করে সে অনুযায়ী সিভি-কভার লেটার বানানো ও জমা দেওয়া, আগে থেকে মেলার ফ্লোর প্ল্যান সংগ্রহ করে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করে মেলার প্রথমেই সিভি জমা এবং আলোচনা সম্পন্ন করা, মেলায় এমনভাবে অংশ নিতে হবে যাতে প্রফেশনাল ইমপ্রেশন তৈরি হয় (ইন্টারভিউ ড্রেস, এনার্জি এবং উদ্যমী ভাব প্রকাশ অত্যন্ত জরুরি), অবশ্যই প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে তার সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রাখতে হবে, প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনার শেষের দিকে অবশ্যই তার ভিজিটিং কার্ড, কোম্পানির লিফলেট সংগ্রহ করা এবং এক সপ্তাহ পর অবশ্যই একটি ফলোআপ ই-মেইল পাঠাতে হবে।
বেশিরভাগ চাকরিপ্রত্যাশী মনে করেন চাকরি মেলাগুলো অতীত, অতীতের একটি জিনিস- কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেন, এটি অতীতের এমনই এক সৃষ্টি যা সবসময় বর্তমান হয়ে থাকবে। তাই চাকরিদাতা ও চাকরিপ্রত্যাশী উভয়কেই এটি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।