আমি যখনই মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, বা মালয়েশিয়া ভ্রমণ করি, তখন প্রায়ই সেইসব নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করার চেষ্টা করি, যারা আমাদের বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়োগ দেন। তাদের কাছ থেকে যে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া আমি পেয়েছি তা হলো, আমাদের বাংলাদেশি মানুষদের অত্যন্ত মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে এবং তারা খুব দ্রুত নতুন ভাষা আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়, তা আরবি হোক, মালয় ভাষা বা ইংরেজি। নিয়োগকর্তারা আরও জানান যে, যদিও বেশিরভাগ বাংলাদেশি কর্মীরা কম বা কোনো দক্ষতা ছাড়াই বিদেশে যান, তবে তারা খুব দ্রুতই প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ভূমিকা অপরিসীম। আমরা প্রায়ই বলি, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতির অক্সিজেন। তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠাচ্ছে। কিন্তু বিনিময়ে আমরা তাদের জন্য তেমন কিছুই করি না। আমি মনে করি, আমরা আমাদের প্রবাসী ভাই-বোনদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতি প্রদর্শন করি না। যখনই আমি বিদেশে ভ্রমণের জন্য বিমানবন্দরে যাই, তখন প্রায়ই দেখি আমাদের প্রবাসী ভাইদের অসহায়ত্ব। তাদের প্রতি বিমানবন্দরে সামান্য মমতাও লক্ষ্য করা যায় না।
একটি ছেলে যখন প্রথমবারের জন্য বিদেশে পরিশ্রমের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে, তখন থেকেই তার যন্ত্রণা শুরু হয়। বিমানবন্দরে বিশাল লাইন, আনসারদের দুর্ব্যবহার, বোর্ডিং পাস নেওয়ার সময় বিমানের টিকিট কাউন্টারের অসদাচরণ, ফর্ম ফিলাপের জটিলতা, ইমিগ্রেশন পুলিশের হয়রানি এবং বিমানে উঠতেই বিমানবালাদের অবজ্ঞা—এই সবই তাকে প্রথম ধাপেই হতাশ করে। কিছু যাত্রী তো এসব দেখে মন্তব্য করেন, “বাংলাদেশিরা আদব কায়দা শিখলো না!” আর দালালের মিথ্যা প্রলোভনে তারা বিদেশের মাটিতে পা রাখার পরই শুরু হয় তাদের দুর্ভোগ।
২০২৩ সালে সৌদির রিয়াদ শহরে গিয়েছিলাম। সেখানে পৌঁছানোর পর হঠাৎ করেই দেখি, কোনো এক জটিলতায় আমার হোটেল বুকিং ক্যানসেল হয়ে গেছে, তখন সময় ছিল ভোর ৩টা। এক পাকিস্তানি ট্যাক্সি চালককে বললাম আমাকে কোনো হোটেলে নিয়ে যেতে। হোটেলে পৌঁছানোর পর দেখি সবাই ঘুমিয়ে আছে। আমি জোরে ডাকলাম, তখন একজন বাংলাদেশি ভাই বেরিয়ে এলেন। আমি তাকে দেখেই বুঝতে পারলাম তিনি বাংলাদেশি, কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন না যে আমি বাংলাদেশি। তিনি হিন্দিতে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী সমস্যা?” আমি তাকে বললাম, “ভাই, আপনি কি বাংলাদেশি?” তিনি বললেন, “জি, কুমিল্লার লোক। ১০ বছর ধরে রিয়াদে আছি।” এরপর তিনি এক ঘণ্টার মধ্যে আমাকে অনেক সহায়তা করলেন এবং আমি যতদিন রিয়াদে ছিলাম, প্রতিদিনই আমার খোঁজ নিলেন এবং সাহায্য করলেন। তিনি বললেন, বাংলাদেশিরা অনেকভাবে প্রতারিত হয়। এমন অনেক বাংলাদেশি আছেন যারা একই ছাদের নিচে বছরের পর বছর আছেন, কিন্তু বাইরে বের হওয়ার উপায় নেই। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি ভাবলাম, পৃথিবীর যেসব দেশ রেমিট্যান্সের উপর নির্ভরশীল, তারা তাদের প্রবাসীদের জন্য কী ধরনের উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে? কয়েকটি দেশের উদ্দ্যোগের চিত্রঃ
১. ফিলিপাইন:
ফিলিপাইন সরকার তাদের প্রবাসী নাগরিকদের জন্য বিভিন্ন সুরক্ষা এবং কল্যাণমূলক কর্মসূচি পরিচালনা করে। প্রবাসী ফিলিপিনো কর্মীদের (Overseas Filipino Workers) জন্য তারা “ওভারসিজ ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাডমিনিস্ট্রেশন” (OWWA) গঠন করেছে। এই সংস্থা প্রবাসীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, বীমা, শিক্ষা, এবং পুনর্বাসন সেবা প্রদান করে। এছাড়াও, প্রবাসীদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থান সেবা প্রদান করা হয়।
২. ভারত:
ভারত সরকার প্রবাসীদের উন্নয়নে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। “প্রবासी ভারতীয় দিবস” (Pravasi Bharatiya Divas) উদযাপনের মাধ্যমে প্রবাসীদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এছাড়া, ভারতীয় প্রবাসীদের বিনিয়োগ ও ব্যবসা করার ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করার জন্য “ইন্ডিয়া ডেভেলপমেন্ট ফান্ড” গঠন করা হয়েছে। প্রবাসীদের সন্তানদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি এবং দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতার সাথে কাজ করার সুযোগ প্রদান করা হয়।
৩. মেক্সিকো:
মেক্সিকো সরকার তাদের প্রবাসী নাগরিকদের কল্যাণের জন্য “ইন্সটিটিউট অব মেক্সিকানস অ্যাব্রড” (IME) গঠন করেছে। এই সংস্থা প্রবাসী মেক্সিকানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং আইনগত সহায়তা প্রদান করে। এছাড়াও, প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
৪. সিঙ্গাপুর:
সিঙ্গাপুর সরকার তাদের প্রবাসীদের জন্য বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা এবং কল্যাণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সিঙ্গাপুরের প্রবাসীদের জন্য বিশেষ বীমা এবং স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা রয়েছে। এছাড়া, “ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট বোর্ড” (EDB) প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগ এবং নতুন ব্যবসা শুরু করার জন্য বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করে।
৫. চীন:
চীন সরকার তাদের প্রবাসী নাগরিকদের উন্নয়নে বড় ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। “ওভারসিজ চাইনিজ অ্যাফেয়ার্স অফিস” (OCAO) প্রবাসীদের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক কর্মসূচি পরিচালনা করে। এছাড়াও, প্রবাসীদের দেশে ফিরে আসার জন্য বিনিয়োগের সুযোগ এবং ট্যাক্স সুবিধা প্রদান করা হয়।
প্রবাসী ভাইদের উন্নয়নে আমার কিছু প্রস্তাবনা:
- প্রবাসী কল্যাণ ফান্ডের সম্প্রসারণ ও সেবা বৃদ্ধি: প্রবাসীদের কল্যাণে এবং জরুরি প্রয়োজনে সহায়তা করার জন্য প্রবাসী কল্যাণ ফান্ডের আকার ও সেবার পরিধি বাড়ানো।
- নতুন উদ্যোগ ও বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি: প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে এবং নতুন উদ্যোগ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করতে বিশেষ সুবিধা ও প্রণোদনা প্রদান।
- বীমা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা: প্রবাসীদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা ও জীবনবীমা সহ সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, যাতে বিদেশে অবস্থানকালে তারা নিরাপদ বোধ করে।
- প্রবাসী উদ্যোক্তা নেটওয়ার্ক গঠন: প্রবাসী উদ্যোক্তাদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে এবং যৌথভাবে কাজ করার জন্য একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করা।
- গ্লোবাল বাংলাদেশি বিজনেস নেটওয়ার্ক তৈরি করা: বিশ্বজুড়ে থাকা বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক তৈরি করা, যা ব্যবসায়িক সুযোগ ও বিনিয়োগকে প্রসারিত করবে।
- প্রবাসীদের দক্ষতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগানো: প্রবাসীদের অর্জিত দক্ষতা ও জ্ঞানকে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানোর জন্য বিশেষ প্রকল্প ও কর্মসূচি গ্রহণ করা।
- বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ প্রক্রিয়া সহজীকরণ: প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রক্রিয়া আরও সহজ, দ্রুত এবং সাশ্রয়ী করতে ব্যাংকিং ও মোবাইল ফাইন্যান্স সেবার উন্নতি করা।
- রেমিট্যান্সের জন্য বিশেষ ইনসেন্টিভ প্রদান: প্রবাসীদের আরও রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত করতে বিশেষ বোনাস বা কর ছাড়ের ব্যবস্থা করা।
- প্রবাসীদের দেশের উন্নয়ন প্রকল্পে যুক্ত করা: প্রবাসীদের দেশে ফিরে আসার জন্য এবং দেশের উন্নয়নে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য উন্নয়ন প্রকল্পে যুক্ত করা।
- ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফান্ড গঠন: দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে প্রবাসীদের বিনিয়োগের সুযোগ প্রদানের জন্য একটি বিশেষ ফান্ড তৈরি করা।
- চিপ লেবার শব্দটির ব্যবহার বন্ধ করা: প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তাদেরকে “চিপ লেবার” হিসেবে অভিহিত করা বন্ধ করা এবং তাদের মর্যাদা বাড়ানো।
- হাই ইনকাম নিশ্চিত করার জন্য কারিগরি দক্ষতা নিশ্চিত করা: প্রবাসী শ্রমিকদের উচ্চ আয়ের কাজে নিয়োগের জন্য কারিগরি দক্ষতা উন্নয়নের ব্যবস্থা করা।
- আরপিএল এবং আরসিসি এর সহজীকরণ ও প্রচার করা: প্রবাসীদের দক্ষতা স্বীকৃতি ও উন্নয়নে আরপিএল (Recognition of Prior Learning) এবং আরসিসি (Recognition of Current Competency) প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং প্রচার করা।
- এয়ারপোর্টে আলাদা সেবা নিশ্চিত করা: প্রবাসীদের বিমানবন্দরে সুষ্ঠু ও সম্মানজনক সেবা নিশ্চিত করার জন্য আলাদা কাউন্টার ও দ্রুত সেবা ব্যবস্থা চালু করা।
- প্রবাসী কার্ড প্রদান: প্রবাসীদের জন্য একটি বিশেষ কার্ড প্রদান করা, যার মাধ্যমে তারা ভিআইপি/সিআইপি সুবিধা ও মর্যাদা পেতে পারেন।
উপসংহার:
প্রবাসীরা আমাদের দেশের অর্থনীতিতে যে বিশাল অবদান রাখছেন, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমাদের উচিত তাদের উন্নয়নে আরও উদ্যোগী হওয়া। তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি এবং সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে আমরা তাদের জীবনকে আরও সহজ এবং মর্যাদাপূর্ণ করতে পারি।