আমার স্কুল জীবনের ইংরেজীর একজন শিক্ষক আমাকে সবসময় বলতেন “মনে রাখবি শেষ ভলো যার সব ভলো তার”। তিনি মনে করিয়ে দিতেন ক্লাশ চেষ্ট বা সেমি ফাইনাল পরীক্ষায় যতই ভালো ফলাফল করি না কেন, ফাইনাল পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতেই হবে। আমি যেন ভালো নম্বর পাই তাই প্রায়ই সন্ধার দিকে আমার বাসায় পর্যন্তু চলে আসতেন। স্কুল জীবনে ক্রিকেটের প্রতি ছিল ভীষন ঝোক, একটা সময় সারাদিন মাঠে পড়ে থাকতাম। কি রোদ আর ছায়া, গরম অথবা ঠান্ডা, ক্লাবের মাঠে সব সময় প্রাকটিস। কোচ বলতেন প্রাকটিসে যতই ছক্কা মারো না কেন, ম্যাচের দিন ভালো না করলে কোন লাভ নাই। তাই অবহেলা না করে মন দিয়ে প্রাকটিস করো। পড়াশুনা শেষ করে যখন কর্মজীবন শুরু করলাম তখন বস বলেন অফিসে সহকর্মীরা যতোই আপনাকে ভালো বলুক না কেন, দিন শেষে রেজাল্ট দেখাতে না পারলে কোন লাভ নাই। জীবনে প্রতিক্ষেত্রে একটিই প্রবাদের সাথে আমার বার বার দেখা হয়েছে আর সেটি হলো “শেষ ভালো যার সব ভলো তার”।
আজকে অন্যভাবে উপস্থাপন করতে চাচ্ছি এই প্রবাদটিকে। কর্মজীবনে এর গুরুত্বও আমি টের পেয়েছি। চাকরিজীবী মানেই হলো আপনি কোন একটি বিশেষ ক্ষেত্রে দক্ষ এবং যোগ্য হয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করবেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বললাম এই কারনে যে, কোন একটি প্রতিষ্ঠানে একবছর কাজ করার পর আর একটু ভালো বেতন বা সুযোগ সুবিধার জন্য আপনি কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করবেন এবং এটাই স্বাভাবিক। আমি এতে দোষের কিছু দেখি না। তবে অভিজ্ঞদের মতে যারা বছর বছর কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করে, তারা ক্যারিয়ারের মাঝ পথে এসে হঠাৎই হোচট খেতে পারেন।
যাই হোক কেন বলছি এসব কথা? তার একটি কারন আছে। প্রায় ১৮ বছর হলো কাজ করছি। এই ১৮ বছরে বহু মানুষের সাথে কাজ করেছি এবং করছি। এই মানুষগুলোর সাথে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে বলেই বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতায় নিজের ক্যারিয়ারকে সাজাতে পেরেছি। একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই যেটা পড়ার পর হয়তো বুঝাতে সক্ষম হতে পারি কেন শুরু করেছি “শেষ ভালো যার সব ভলো তার” প্রবাদটি দিয়ে।
রাসেল (ছদ্মনাম) নামে আমার এক সহকর্মী আমার সাথে ২০০৯ সালের দিকে কাজ করেছে। প্রথম দিন থেকেই ও সবার মন জয় করে নিয়েছিল। ওর ভেতর একধরনের আগুন ছিল অনেকটা রকেটের মতো। রকেট যেমন নিচ থেকে আগুনের চাপে উপরের দিকে ধাবিত হয় যাকে ইংরেজীতে Thrust বলে ঠিক সেরকম। যেকোন এ্যাসাইনমেন্ট সময়তো শেষ করেই তারপর ক্ষান্ত হতো। ওর যে গুনগুলো আমাকে মোহিত করত যেমনঃ
- সময়ের সদ্বব্যবহার করা
- যেকোন মূল্যে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা
- সাহস এবং উদ্দ্যম নিয়ে পেছনে না ফিরে সামনের দিকে এগিয়ে চলা
- কৌতুহলী মনোভাব পোষন করে সুযোগকে নিজের মতো করে তৈরী করে নেয়া
- আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সকলের মন জয় করা
- সকলের সাথে মিলে কাজ সম্পন্ন করা
- প্রত্যেকের মনোভাব, মতামত এবং মানসিকতাকে সমানভাবে গুরুত্ব দেয়া
- নিজের পজিটিভ আচার আচরনের ব্যাপারে সর্বদা সচেতন থাকা
- কখনও নিজের নৈতিকতাকে বিষর্জন না দেয়া
- কাজের ব্যাপারে সবসময় নিষ্ঠাবান থাকা
- নতুন সম্পর্ক তৈরীর সাথে সাথে পুরানো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকা
- যথাযথভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
একসাথে অনেকদিন কাজ করেছি এবং অনেক কাজ সহজেই প্রত্যাশা অনুযায়ী উঠিয়ে নিয়ে এসেছি এবং এভাবে চলতে লাগলো অনেকদিন। তারপর একদিন এসে আমার কাছে বললো স্যার আমি নিজেকে নিয়ে আর একটু এক্সপেরিমেন্ট করতে চাই। সেলস এন্ড মার্কেটিংয়েই থাকবো তবে সেক্টরটা পরিবর্তন করতে চাই। আমি আপনার কাছে অনুমতি চাইছি। আমরা দুজনে মিলে টাইম ফ্রেম নির্ধারন করলাম এবং ওর হাতে যে দায়িত্বগুলো ছিল সেগুলো কিভাবে সম্পন্ন হবে তারও একটা পথ বের করলাম। অবাক করার ব্যাপার হলো যে মাসটি ওর জন্য আমাদের কর্মক্ষেত্রে শেষ মাস ছিল সে মাসেই ওর সেলস এ্যাচিভমেন্ট অন্য মাসের চেয়েও বেশী ছিল। আমাদের প্রতিষ্ঠানে শেষ দিন পর্যন্তু সে প্রথম দিনের মতোই কাজ করে গেছে।
উপরের যে ঘটনাটি উল্লেখ করলাম তা সাধারনত খুব একটা দেখা যায় না। একটি কাজে থাকা অবস্থায় নতুন আরেকটি কাজের সন্ধান পেলে বর্তমান কাজের কথা আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুলে যাই। হবু নিয়োগকর্তাকে খুশি রাখতে গিয়ে বর্তমান নিয়োগকর্তাকে ভুলেই যাই। তখন আর আমাদের মনেই থাকে না যে আমার বর্তমান কর্মক্ষেত্রের শেষ কর্মদিবস আমার ক্যারিয়ারের জন্য কতবেশী গুরুত্ব বহন করে। শেষ ভালো যার সব ভালো তার, শেষ মাসকে যদি সেরা মাস বানাতে পারি তাহলে নতুন কর্মক্ষেত্রে গিয়েও পুরানো কর্মক্ষেত্রের পূর্ন সমর্থন আমরা আশা করতে পারি। আর যাদি মনে করি নতুন কর্মক্ষেত্র, নতুন বেতন, নতুন সহকর্মী, নতুন পরিবেশ আর তার চিন্তায় যদি বর্তমান দিনকে অবহেলা করি তাহলে আমার জন্য ”আমও গেল, ছালাও গেল” প্রবাদটি অবধারিতভাবে সত্য হয়ে যাবে। ধরুন আপনি বর্তমান কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় আরেকটি সুযোগ পেয়ে গেলেন, তখন আপনার কি করা উচিত হবে?
- আপনার বসের কাছে গিয়ে সরাসরি ব্যাখ্যা করুন
- আপনার উপর যে অর্পিত দায়িত্ব আছে সেগুলোর সমন্বয় কিভাবে করবেন তার পরিকল্পনা করুন
- যাকে আপনি আপনার দায়িত্বগুলো বুঝিয়ে দেবেন তার সাথে বসে পরিকল্পনা করুন
- সবগুলো অবশিষ্ট কাজ একটি এক্সেল শিটে ফেলে ট্র্যক করুন
- দলের প্রত্যেকের কাছ থেকে জেনে নিন কারো কোন কাজের সাথে আপনি সংযুক্ত আছে কিনা
- এডমিন এবং একাউন্টসের সাথে পৃথকভাবে বসুন এবং তাদের কাছ থেকেও আনঅফিসিয়ালী ছাড়পত্র নিন।
- নতুন কর্মক্ষেত্রে যাবার আগে অবশ্যই আপনার বর্তমান কর্মক্ষেত্রের নিয়মগুলো জেনে নিন। অনেক সময় এমন হয় যে আপনি নতুন নিয়োগকর্তাকে বললেন আপনি যেকোন সময় যোগ দিতে পারবেন কিন্তু আপনার বর্তমান কর্মক্ষেত্রের নিয়মে সেটা উল্লেখ নেই। তখন আপনি বিপদে পড়তে পারেন। আবার নতুন নিয়োগকর্তাও বুঝে যাবে নৈতিকতার জায়গায় আপনি নড়বড়ে।
আমাদের সকলের মনে রাখতে হবে মানুষের জীবনের সফলতার জন্য প্রয়োজন টেকসই সম্পর্ক যা তার সপ্নকে বাস্তবায়ন করতে সাহায্য করে। আমরা জানি না বা কখনো আগাম বলে দিতেও পারি না কোন সুসম্পর্ক কোন সময় আমার কাজে আসবে। কিন্তু এ কথা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি আমার সাফল্য অর্জন এবং সেটা ধরে রাখার জন্য আমি একাই যথেষ্ট না। আমারও সহযোগীতার প্রয়োজন আছে। তাই আমি মনে করি এই মুহুর্তে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছেন তারা আপ্রান চেষ্টা করুন যেকোনভাবেই হোক একটা ইন্টার্নশীপ বা ভলেটিয়ারী কাজ যোগার করবার জন্য। যদি বিনা পয়সায় করতে হয় তাহলেও পিছ পা হবেন না এবং ঐ কর্মক্ষেত্রের শেষ কর্মদিবস পর্যন্তু আপনার সেরাটি দিয়ে যাবেন। দেখবেন ঐ শেষ দিনের সেরা কাজটিই আপনাকে ভবিষ্যতে কোন না কোনভাবে সাহায্য করবে।