গত দু-মাস ধরে দুটি শব্দ বার বার শুনছি ”নিউ নরমাল”। গুগলকে প্রশ্ন করতেই সে জানালো এর আগেও এই শব্দ দুটি ব্যবহার করা হয়েছে ২০০৭-২০০৮ সালে যখন বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা গ্রাস করেছিল প্রায় পুরো বিশ্বকে। তখন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা ”নিউ নরমাল” শব্দ দুটি সংযুক্ত করেছিলেন মন্দা পরতর্তী ব্যবস্থাপনা নির্ধারন করতে গিয়ে। বর্তমানের এই কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবে সৃষ্ট মহামারীতে যখন সমগ্র বিশ্ব আক্রান্ত তখন আরেকবার আমাদের সামনে এসে দাড়িয়েছে ”নিউ নরমাল“। অতীতে যে বিষয়গুলো অস্বাভাবিক বলে বিবেচিত হতো সেটাই যখন দৈনন্দিন কার্যক্রমে যুক্ত হয়ে নিয়মে পরিনত হয় তখনই সেটাকে বলা যায় ”নিউ নরমান”। তবে সময় যত সামনের দিকে এগিয়ে যায় ”নিউ নরমাল” তত দ্রুত “নরমালে” পরিনত হয়। এক সময় মা’র কাছে শুনেছি আমার বাবা কোথাও বেশী দিনের জন্য গেলে চিঠি লিখে জানাতেন ”আমি ঠিক মতো পৌছেছি”। তারপর চিঠির পরিবর্তে এলো ল্যান্ডফোন, পুরো সিস্টেম পাল্টে গেলো। তখন বাড়িতে ফোন করে জানাতেন ”আমি ঠিক মতো পৌছেছি”। এখন কোথাও গেলে বাসা থেকে কিছুক্ষন পর পর ফোন আসে “এখন কোথায়”। এর মাঝে আবার টেলিগ্রামের সাথে মানুষের পরিচয় হয়। যেহেতু চিঠি পৌছুতে সময় নিতো প্রায় একমাস (কখনো কখনো), তাই অতি প্রয়োজনীয় বিষয়ে টেলিগ্রাম আসতো “Father Sick, Come Early”। পরবর্তীতে যার রুপান্তর আমরা দেখতে পাই এসএমএস (Short Message Service)।
শুনেছি প্রথম শিল্প বিপ্লবের পর যখন শিল্পায়নের যুগ শুরু হলো তখন কারখানা থেকে একদল কর্মী নিয়োগ দেয়া হতো শ্রমিকদের ঘুম থেকে উঠাবার জন্য। পরবর্তীতে অ্যালার্মঘড়ি আসার পর তখনকার নরমাল হয়ে গেলো নিউ নরমাল এবং কিছু মানুষ হয়ে গেলো বেকার আর কিছু মানুষের হলো কর্ম পরিবর্তন। মানুষের মধ্যে একটি দল আছে যাদের সমগ্র জীবনের প্রচেষ্টাই হলো যে কোনভাবেই হোক নরমালকে চ্যালেঞ্জ করা। আবার অন্যদলের কাজ হচ্ছে যেকোন ভাবেই হোক নরমাল কে আকড়ে ধরে থাকা এবং স্বাভাবিকভাবে নরমাল কে আকড়ে ধরে থাকা মানুষদেরই বিজয় হয় (কিছুদিনের জন্য) যদি না প্রাকৃতিকভাবে কোন বিপর্যয় এসে উপস্থিত না হয়। একটি আর্টিক্যালে পড়েছি একসময় প্লেগের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাবে বিজ্ঞানী নিউটন কোয়ারেন্টিনে চলে যান তার গ্রামের বাড়িতে এবং কোন একদিন দুপুরের খাবারের পর বিশ্রাম নিচ্ছিলেন আপেল গাছের নিচে আর তখনই তার মাথার উপর পড়ে একটি বড় আপেল এবং আমরা পেয়ে যাই নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র (সঠিক কিনা জানি না তাও উল্লেখ করলাম, আপনারা গুগল ঘেটে বের করতে পারেন চাইলে)।
বর্তমানে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের কারনে আমাদের সামনে আবার উপস্থিত হয়েছে ”নিউ নরমান” যার মানে হচ্ছে স্বাভাবিক বা গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচলনা করা (সেটা মন থেকে হোক বা মনের বিরুদ্ধে গিয়ে হোক)। আমাদের সবারই প্রয়োজনের স্বার্থে মেনে নিতে হচ্ছে। তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় একবার যেটি অভ্যাসে পরিনত হয় তা পুনরায় না করাটা কষ্টের। মানে হচ্ছে নতুন নিয়মে যা করে আসছি সেটা হয়তো সম্পূর্ন পরিবর্তন নাও হতে পারে।
মার্চের শুরুর দিকে আমরা বুঝতে শুরু করি এতোদিন যেভাবে স্বাভাবিক নিয়মে কাজ করে এসেছি সেটা পাল্টে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন বিভিন্ন দেশের প্রফেশনালদের দ্বারা আয়োজিত বিভিন্ন ওয়েবইনারে আমরা অংশ নিয়েছি কিন্তু সেই ওয়েবইনার যখন আমাদেরই করতে হচ্ছে এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অংশ নিচ্ছেন অনেকেই তখন ব্যাপারটি প্রথম দিকে ছিল অবাক করার মতো। তার চেয়ে বড় কথা যারা ”পারি না” বা ”হবে না” বলে নিশ্চিত ছিলেন তাদেরও দেখতে পাচ্ছি স্বাচ্ছ্যন্দে অনলাইনের সাথে মিশে গেছেন। এরই মধ্যে আমরা বিভিন্ন অনলাইন ইন্টারেক্টিভ মিটিং টুলস যেমন গুগল মিট, জুম, গো-টু-মিটিং, গো-টু-ওয়েবইনার, ওয়েবএক্স, মাইক্রসফ্ট মিটিং, স্ট্রিমইয়ার্ড, বি-স্ট্রিম, বি-লাইভ বা বিগ-ব্লু-বাটন ইত্যাদি ভার্চৃয়াল মিটিং প্লেসের সাথে পরিচিত হয়ে গিয়েছি। জব বা প্রজেক্ট ট্রাকিং হচ্ছে প্রযুক্তি ব্যবহার করে, কাস্টমার ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে ভার্চুয়ালী, এইচআর ব্যবস্থাপনা হচ্ছে প্রযুক্তিকে সাথে নিয়ে। এ সকল অনলাইন ইন্টারেক্টিভ টুলসগুলোই আসলে নিউ নরমাল টুলস হিসেবে আমাদের সামনের দিনে দৈনন্দিন ব্যবহারযোগ্য বিষয় হয়ে দাড়াবে।
৪ মাস আগেও বাংলাদেশে ই-কমার্স বা ই-বিজনেস ছিল সৌখিনতা আজ তা বাস্তবতা। ৪ মাসে আগেও ভার্চুয়ার অফিস বা হোম অফিস ছিলো ”ভালো একটি ব্লগ পড়বার জন্য” কিন্তু এখন তা বাস্তবতা। অনেকে ইতিমধ্যেই চিন্তা করা শুরু করেছেন কি দরকার এতো টাকা খরচ করে অফিস ভাড়া নেবার। প্রয়োজনের উপর ভিত্তি করে শেয়ারিং অফিস বা শেয়ারিং ওয়ার্কস্টেশন হতে পারে একটি কার্যকরি সল্যুশন। হয়তো এমন হবে পাঁচতলা ভবনে ২০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা যেখানে শুধুমাত্র জরুরী কিছু কাজের জন্য আসা হবে।
আমি চিন্তা করছিলাম যে কি কি কারনে আমরা অফিসে একসাথে বসে কাজ করি। বড় একটি লিষ্ট আমার সামনে চলে আসলো। আমরা সাধারনত অফিসে যে কাজগুলো করি তা হলোঃ
- রেজিস্ট্রি খাতায় নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করি যার ভিত্তিতে বেতন নির্ধারিত হয়।
- অফিসিয়াল ইমেল করি অফিসে বসে
- সভা বা আলোচনায় অংশ নেই
- নথিপত্র ঠিক করি এবং সংরক্ষণ করি
- কাজের ট্র্যাকিং করি
- চাকরীর জন্য সাক্ষাৎকার নেই বা দেই
- কর্মীদের বার্ষিক মূল্যায়ন করি
- গ্রাহক সম্পর্ক উন্নয়ন করি
- কাজের প্রতিবেদন তৈরি করি এবং জমা দেই
- আর্থিক হিসাব-নিকাশ করি
- প্রস্তাবনা খসড়া তৈরি করি এবং প্রয়োজনীয় অনুমোদন দেই
- প্রচারমূলক কনটেন্ট তৈরি করি
- সোস্যাল মিডিয়া পরিচালনা করি
- অনুষ্ঠান আয়োজন করি
- এইচআর ক্রিয়াকলাপ করি
- পণ্য / পরিষেবা সমীক্ষা করি ইত্যাদি।
এর বাইরেও আরো অনেক কিছু তালিকায় আসতে পারে। গতানুগতিকভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে উপরের কাজগুলো ম্যানুয়ালি করতে হবে কারন অনলাইনে সবগুলোকে নিয়ে আসতে গেলে প্রয়োজন হবে সফ্টওয়্যার, হার্ডওয়্যার, নেটওয়ার্ক, নিরাপত্তা, স্টোরেজ সহ বিভিন্ন কিছুর। আমার নিজের বিশ্বাসও ছিল তাই। আমি এই বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করেছি এবং বিভিন্ন উন্নত দেশে এর প্রয়োগও দেখেছি কিন্তু এই প্যান্ডেমিকের ভেতর আমি এবং আমার পুরো টিম ব্যবহার করলাম “ক্লাউড ভিত্তিক অনলাইন অফিস”। আপনারা যারা আমার আর্টিক্যাল পড়ছেন তারা চাইলেই ক্লাউড সার্ভিস প্রোভাইডারদের সম্পর্কে গুগলের মাধ্যমে ধারনা নিতে পারেন।
একটা সময় ধারনা করা হতো যে আপনার পুরো অফিসের কার্যক্রম প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্পন্ন করতে গেলে সম্ভবত অনেক বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে এবং যেটি একটি সময় পর্যন্ত বাস্তবতা ছিল। যাকে আমরা বলতাম “On Premises Software (On Prem)” মানে সফ্টওয়্যার যার সাথে আপনার ম্যানেজ করতে হবে হার্ডওয়্যার, নেটওয়ার্ক, ডাটা ম্যানেজমেন্ট, নিরাপত্তা, স্টোরেজ সবকিছু। প্রয়োজন হতো মোটা অংকের বিনিয়োগ, লোকবল এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তার। সাধারন ভাষায় বললে আপনার বাড়িতে আপনিই খাবার তৈরি করে খাবেন তার পর নিজেই সংরক্ষন করবেন। তখন আমরা ভাবলাম এতো ঝামেলাতে না গিয়ে ম্যানুয়ালী অপারেশনই ভালো। গ্লোবালী বিশেষজ্ঞরা চিন্তা করলেন “Infrastructure As A Service (IAAS)” যার মানে হলো সফ্টওয়্যার আপনার, হার্ডওয়্যার অন্যের। এখানে কিছু মানুষ আগ্রহী হলেন কারন বিনিয়োগের পরিমান কমে গেলো এবং নিরাপত্তা কিছুটা নিশ্চিত হলো। সহজভাবে বললে বাইরে থেকে রেডী ফুড এনে ঘরে গরম করে খাওয়া। এরপরও পরোপুরী ম্যানুয়াল অপারেশন থেকে বের হতে পারিনি। এবার বিশেষজ্ঞরা চিন্তা করে বের করলেন “Platform as a Service (PAAS)” মানে হলো আপনার বাড়িতে শুধু ডাইনিং টেবিল এবং পানি থাকলেই হলো, বাকিটা সব ভেন্ডরের (ফুডপান্ডা থেকে বার্গার চলে আসার মতো বিষয়)। চতুর্থ শিপ্ল বিপ্লবের অন্যতম একটি বড় বিষয় হচ্ছে অগ্রগামীতা। মানুষ প্রতিনিয়ত চিন্তা করে বের করছেন আরো কিভাবে সহজ করা যায় ব্যবসায়িক এবং ব্যক্তিগত দৈনন্দিন কার্যক্রম। কারন আমাদের সামনে আছে প্রযুক্তি। আমাদের সামনে চলে আসলো “Software As A Service (SAAS পদ্ধতি)” যেটি সত্যিকার অর্থে আমাদের অনলাইন বা ভার্চুয়াল অফিসের স্বাদ দিচ্ছে। সহজ ভাষায় খাবার খাচ্ছি কিন্তু লোকেশন মূখ্য নয়। উদাহরন স্বরুপ ISP (Internet Service Provider), ব্যবহারের উপর ব্যান্ডউইথ চার্য দিচ্চেন।
ক্লাউড ভিত্তিক অনলাইন অফিসের স্বাদ আমরা যারা অগ্রগামীতাকে অনুশীলন করছি তারা সত্যিকার অর্থে পেতে শুরু করেছি। যেখানে কর্মীরা তাদের ঘরে বসেই নিশ্চিত করছেন টিমওর্য়াকের মাধ্যমে কোয়ালিটি ওয়ার্কস। টিম লীডার জানতে পারছেন প্রতিষ্ঠানে কার অবস্থান কোন পর্যায় এবং কর্মী তার নিজের মাসিক আমলনামা নিজেই বিবেচনা করতে পারছেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে।
আগামী দিনের ব্যবসা হবে আরো গতিসম্পন্ন যেখানে দৈহিক উপস্থিতি মূখ্য হবে না। অধিকাংশ পদ বা পদবীর সাথে যুক্ত হবে ভার্চুয়াল শব্দটি। বেকারত্বের হার হ্রাস পাবে কারন ভার্চুয়াল উপস্থিতির মাধ্যমে যে কেউ যেকোন জায়গা থেকে যুক্ত হয়ে কাজ করতে পারবেন। হয়তো একজন মানুষ দৈনিক একাধিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করবেন। মেধা ভিত্তিক কাজ বৃদ্ধি পাবে, শ্রমের মূল্য বেড়ে যাবে এবং প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। আমার ব্যক্তিগত মতামত যদি তুলে ধরি তাহলে বলবো নিউ নরমালে এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে কারা টিকে থাকবে এবং কারা ঝড়ে পড়বে। নিঃসন্দেহে ”হবে না’র তালিকা বড় কিন্তু অগ্রগামী ব্যবসা বা মানুষের কাছে হবে’র তালিকা তার চেয়েও বড়। তবে এখানে ইমোশনের জায়গাটা কিভাবে নিশ্চিত করা যায় সেটি নিয়ে ভাবতে হবে যেহেতু দৈহিক উপস্থিতি হচ্ছে না। তাই বাস্তবতা এবং আবেগের মধ্যে ব্যবধান কিছুটা বাড়তে থাকবে।
সবশেষে বলবো নিউ নরমাল অনিবার্যই ছিল তবে কোভিড-১৯ এর গতি বৃদ্ধি করেছে। তাই নিউ নরমাল কে নিয়ে ট্রল নয় বরং বাস্তবতার আলোকে আমি কিভাবে আলিঙ্গন করবো তা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। হতে পারে আগামীকালই আমার অস্তিত্বের চ্যালেঞ্জকে আমাকে মোকাবেলা করতে হবে।
(বি:দ্রঃ ক্লাউড ভিত্তিক অনলাইন অফিস বিষয়ে আরো অনেক বিষয় উল্লেখ করা যায় তবে আর বাড়াতে চাচ্ছি না। যদি কারো আগ্রহ থাকে আমার সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ করতে পারেন। আমি বিনামূল্যে সহযোগীতা করবো।)
লেখকঃ কে এম হাসান রিপন,
প্রতিষ্ঠাতা, 1.40 Knowledge Initiative এবং নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউট
ফোনঃ ০১৭১৩৪৯৩২06 | ইমেইলঃ [email protected]
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নিউ নর্মাল নিয়ে এমন গোছানো ও ইন ডিটেইল্ড লেখা এই প্রথম পেলাম। অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। অসংখ্য ধন্যবাদ।
Well said dear Ripon Bhai. Very informative. I’m impressed.
It’s true that, we have to take ‘new normal’ as blessing. We have to ready ourselves to the 4th revulsion. Thank you for this important thinking.
Repon Vai,
Really Great & timely write up .
All we must have to updated & go through needs of the time to survive .
Salute BRO ! ❤
Wonderful & absolutely praiseworthy !
Well written. Thanks for the write-up.
স্যার এই অতিপ্রিয় সত্য কথাগুলো লেখবার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
Excellent article about “New Normal”.