7F9A7856

ক্যারিয়ার চিন্তা কখন?

পড়াশুনা শেষ করে তারপর হয় চাকরি না হয় ব্যবসা, এই রকম চিন্তাধারা থেকে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের বের হয়ে আসতে হবে। বেশ কিছুদিন আগে আমি ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটি মাইন্ড ম্যাপ তৈরি করেছিলাম যেখানে আমি দেখাবার চেষ্টা করেছি কিভাবে ক্যারিয়ার প্ল্যান করে শিক্ষাজীবনকে পরিচালিত করা যায়। আমার এবারে লেখা আমার তৈরি করা সেই মাইন্ড ম্যাপকে নিয়ে।

পড়াশুনা শেষ করে তারপর হয় চাকরি না হয় ব্যবসা, এই রকম চিন্তাধারা থেকে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের বের হয়ে আসতে হবে। একজন শিক্ষার্থীর জন্য তার শিক্ষা জীবন হচ্ছে অত্যন্ত মুল্যবান। পলিটেকনিক কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ বছরে, একজন শিক্ষার্থী তার জীবন গড়ার জন্য যা ইচ্ছা তাই করতে পারে, যা চায় তাই পেতে পারে, যাকে প্রয়োজন তার কাছেই পৌছতে পারে। প্রত্যেক সফল ব্যাক্তিই তার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে কর্মঠ, বুদ্ধিমান এবং সৎ তরুনদের সান্নিধ্য কামনা করেন। তাদের মেধা এবং বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে সচেষ্ট থাকেন। সেজন্য আমরা তরুন শিক্ষার্থীদের কদর এবং গুরুত্ব যুগযুগের ইতিহাস ঘাটলেই দেখতে পাই। কিন্তু দূর্ভাগ্য হলেও সত্য যে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই তার এই শিক্ষা জীবনের গুরুত্বকে অনুধাবন করতে না পেরে অবহেলায় ৪/৬টি গুরুত্বপূর্ন বছর নষ্ট করে ফেলে। ছাত্রাবস্থায় কিভাবে নিজের কর্মদক্ষতা নিশ্চিত করা যায় এবং ছাত্রজীবন শেষ করেই, ডিগ্রী পাওয়ার সাথে সাথেই কিভাবে চাকরি বাজারে প্রবেশ করা যায় তার ওপর আজকের এ লেখা । এখানে এমন সাতটি বিষয় আলোচনা করেছি, যেগুলো অনুশীলন করলে ছাত্র অবস্থায় নিজের কর্মদক্ষতা নিশ্চিত করতে পারবেন যে কোনো শিক্ষার্থী। এগুলো মেনে চললে ভবিষ্যতে থাকবে না কোনো হতাশা, সাফল্য তাকে ডাকবে হাতছানি দিয়ে, চিন্তা থাকবে না চাকরির বা ব্যবসার। ১. হার্ড স্কিলস:

যারা বিশ্ববিদ্যালয় বা পলিটেকনিকে পড়াশুনা করছেন, তাদের প্রত্যেকেরই ভাবনা যে, ‘চার বছর পরে আমি একজন গ্রাজুয়েট হবো বা একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার হবো।’ এই পড়াশুনা অবস্থায় একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে, ভালো সিজিপিএ অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে যত কম সিজিপিএ, ততো বেশি পরিশ্রম এবং ভবিশ্যতে কষ্ট বা হতাশা আসতে পারে আপনার কর্মজীবনে। কিন্তু এ কথা বলা যাবে না যে, ভালো সিজিপিএ না পেলে একেবারেই কিছু হবে না। শুধু মাথায় রাখা প্রয়োজন, সিজিপিএ যতো ভালো হবে, আপনার অর্জনটা ততই এগিয়ে থাকবে। তাই চারটা বছর পরিশ্রম করুন, ভালো একটা সিজিপিএ অর্জনের জন্য।

১.১ কিভাবে ভালো সিজিপিএ অর্জন করবেন:

# নিয়মিত ক্লাশ করা এবং শিক্ষকদের লেকচার চোখ, কান ও মন দিয়ে শোনা এবং যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হলো সেটা কে স্মরণে রেখে প্রশ্ন করা,   শিক্ষকদের কাছ থেকে উত্তর বুঝে নেয়া এবং বাড়িতে গিয়ে গবেষনা করা।

# ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব তাদের সাথেই করতে হবে যারা ক্যারিয়ার নিয়ে সচেতন এবং ভলো কাজের জন্য উদ্দ্যমী।

#লাইব্রেরী হতে হবে প্রিয় জায়গার মধ্যে একটি।

#গ্রুপ ভিত্তিক পড়াশুনা করতে হবে এবং যে বিষয়টি ভালো বুঝি সেটা আপনার বন্ধুদের বুঝাতে সাহায্য করতে হবে (Teach other to become Master) কনসেপ্ট।

২. টেকনিক্যাল স্কিলস বা কারিগরি দক্ষতা:

একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে কেউ যদি বলে যে, তার কারিগরি জ্ঞান নেই, তাহলে তিনি কিন্তু পিছিয়ে থাকবেন। কারন বিশেষজ্ঞরা জোড় দিয়ে বলার চেষ্টা করছেন ”বেকারত্ত্বের ভ্যাকসিন কারিগরি দক্ষতা”। সেজন্য প্রত্যেক গ্রাজুয়েটের এক হাতে থাকবে তার সনদ, অন্যদিকে থাকতে হবে টেকনিক্যাল স্কিলস বা কারিগরি দক্ষতা। এজন্য তার যেসব বিষয়ে দক্ষতা থাকা জরুরী-

প্রথমত, কম্পিউটার অফিস এপ্লিকেশনস তথা এমএস ওয়ার্ড, এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্ট পুরোপুরি আয়ত্বে রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, বেসিক আইটি দক্ষতা যেমন ইন্টারনেট এন্ড ইমেইল বিশেষ করে কিভাবে সহজে এবং দ্রুততার সাথে গুগলকে ব্যবহার করা যায়, জিমেইলের ফিচারগুলো কে পরিপূর্নভাবে ব্যবহার করা যায়।

তৃতীয়ত সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং। ফেসবুক, লিংকডইন, ইউটিউব ইত্যাদি কিভাবে কাজ করছে তার জ্ঞান অবশ্যই তাকে রাখতে হবে, বিশেষ করে বর্তমানে এফ-কমার্সে বা ই-কমার্সের যুগে এই বিষয়ে ধারনা কম থাকলে চলবে না ।

চতুর্থ বেসিক ডিজাইনিং দক্ষতা বিশেষ করে ফটোশপ এবং ইলাস্ট্রেটরের মতো বেসিক এডিটিং এর কাজগুলো অবশ্যই আয়ত্বে রাখতে হবে। এছাড়াও বেসিক এডিটিং স্কিলস যেমন ভিডিও এডিটিং, বেসিক এ্যানিমেশন এই প্রাথমিক দক্ষতাগুলো আত্মবিশ্বাসকে অনেকগুনে বাড়িয়ে দেবে।

৩. সফট স্কিলস:

মানুষের জীবন টিকে আছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে যোগাযোগের ওপর ভিত্তি করে। মানুষকে প্রতিনিয়তই যোগাযোগের ওপর থাকতে হয়, আদান-প্রদান করতে হয় তথ্যের। এই তথ্যের আদান-প্রদানে যদি ভুল হয়ে যায় তাহলে নিজের নির্ধারন করা লক্ষ্যে পৌঁছানো দুরূহ হয়ে পড়ে। সেজন্য যোগাযোগের ক্ষেত্রে অবশ্যই দক্ষতা অর্জন করতে হবে। লেখা, পড়া, কথা বলা, অন্যকে কনভিন্স করা, অন্যকে বোঝাতে পারা, রিস্ক নেয়া, সঠিকভাবে চিন্তা করা প্রভৃতি বিষয়গুলোই হলো সফট স্কিলস। এগুলোতে দক্ষতা অর্জন করতে না পারলে চাকরির বাজার কিংবা উদ্যোক্তাদের জগতে বেশী দূর আগানো সম্ভব হবে না। তাই সফট স্কিলস শক্তিশালী করতে প্রচুর চর্চা করতে হবে, এবং সেটা ছাত্রাবস্থাতেই।

৪. ল্যাংগুয়েজ স্কিলস বা ভাষাগত দক্ষতা:

আমরা অন্যের কাছে তথ্য পৌঁছাই ভাষার মাধ্যমে। নিজের অভিব্যক্তি, চাওয়া-পাওয়া অন্যের কাছে প্রকাশ করি এই ভাষার মাধ্যমেই। শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষার প্রতি তো অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। আঞ্চলিকতা ছাড়া শুদ্ধ প্রমিত বাংলা চর্চার পাশাপাশি অন্য একটি ভাষার ওপর ভালো দক্ষতা রাখতে হবে। এটি হতে পারে চাইনিজ, জার্মান, ইংলিশ বা অন্য কিছু। অন্য আরেকটি ভাষা আয়ত্বে রাখলে, যারা শুধু একটি ভাষায় দক্ষ তাদের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকা যাবে। যে যতো বেশি ভাষায় দক্ষতা রাখবে, সে ততো এগিয়ে থাকবে।

৫. ওপেন টু লার্ন এপ্রোচ:

বর্তমান সময়ে পৃথিবীর সবকিছুই রয়েছে হাতের ছোট্ট একটি ডিভাইসে। এক ক্লিকেই চলে যাওয়া যাচ্ছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। এখন বিভিন্ন জায়গায় ফ্রী বা অল্প খরচে ওয়ার্কশপ, সেমিনার, বুট ক্যাম্প, ফেস্টিভ্যাল, কনফারেন্স, সিম্পোজিয়াম হচ্ছে। আমরা সোশ্যাল মিডিয়াতে সেগুলো দেখতে পাচ্ছি, বা নোটিফিকেশন পাচ্ছি কিন্তু আমি কখনো সেগুলোতে অংশগ্রহণ করছি না। এটা আমাকে পিছিয়ে রাখছে অন্যদের থেকে। ওপেন টু লার্ন এপ্রোচ হচ্ছে এটাই। মনে রাখতে হবে নিজের নলেজ ব্যাংক যতো সমৃদ্ধ হবে, সুযোগের সংখ্যা ততো বৃদ্ধি পাবে কারন প্রতিদিন আমাদের চোখের সামনেই অনেক সুযোগের হাতছানী থাকে কিন্তু জ্ঞান, দক্ষতার এবং সঠিক আচরনের অভাবে সেগুলো আমরা ছুয়ে দেখবারও সাহস করতে পারি না। কবর থেকে দোলনা পর্যন্তু আমাদের শেথার সময় তার মধ্যে শিক্ষা জীবনের ১০/১২টি বছর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন।

৬. একজন মেন্টর খুজে নেয়া:

‘ফাইন্ড এ মেন্টর’ ধারণাটি অনেক পুরনো। এক্সপার্ট কাউকে মেন্টর হিসেবে বেছে নিতে হবে যার কাছে সে যেকোনও বিষয়ে পরামর্শ নিতে পারবে। যোগাযোগের এ যুগে সেরকম কাউকে খুঁজে বের করা কঠিন কিছু না। সাফল্য পেতে হলে এরকম আদর্শ কাউকে খুঁজে নেয়া দরকার। হয়তো একদিনেই এরকম কাউকে পাওয়া যাবে না, কিন্তু চেষ্টা করলে পাওয়া সম্ভব। তার পরামর্শ, নেটওয়ার্ক, অভিজ্ঞতা, সাহায্য আপনাকে অনন্য এক জায়গায় নিয়ে যেতে পারে।

৭. অভিজ্ঞতা:

আমাদের অনেকের মনে হয়, আমি তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছি, আমিতো কোনো চাকরি বা কাজ করিনি। আমি অভিজ্ঞতা কোথা থেকে পাবো? কিন্তু একজন মানুষ চাইলে তার শিক্ষাজীবনে অসংখ্য অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন। যেমন: বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক সংগঠন ও ক্লাব থাকে। সেখানে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও ইভেন্ট হচ্ছে। সেখানে শিক্ষক শিক্ষার্থী ও সংগঠনগুলোর সাথে যুক্ত হয়ে তাদের সাথে কাজ করে অসাধারণ অভিজ্ঞতার পাশাপাশি অর্জন করা যাবে প্রশংসাপত্র। পড়াশুনা চলাকালীন অনেক সংগঠন পার্ট-টাইম, ফুল-টাইম বা চুক্তিভিত্তিক কাজ করার সুযোগ দিচ্ছে, সেখান থেকেই অর্জিত হতে পারে দারুণ সব অভিজ্ঞতা।

ইংরেজীতে একটি প্রবাদ আছে “Practice Makes Perfect- অনুশীলনে সবই সম্ভব”। উপরোক্ত সাতটি বিষয় যদি কোনো শিক্ষার্থী ছাত্রাবস্থায় অর্জন করতে পারে পর্যাপ্ত অণুশীলনের মাধ্যমে, তবে নিশ্চিত করেই বলা যায় তার পরবর্তী জীবনে সফলতা হাতছানি দিয়ে ডাকবে, তাকে চিন্তা করতে হবে না কাজ নিয়ে।

এই বিষয়ে ভিডিওর মাধ্যমে জানতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন Start ______________________________________________________________________________________________________ লেখকঃ কে এম হাসান রিপন, নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউট

Comments are closed.