নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিশ্বাসী কিছু সাথী ছিলেন কিন্তু তিনি শেষের দিকে এসে একটু বেশী আবেগী হয়ে ঝুকে পড়ে ছিলেন প্রধান সেনাপতী মীর জাফরের দিকে। অনেকের অনেক বারণ করা স্বত্ত্বেও বাংলার শেষ নবাব সিদ্ধান্ত নিলেন যেটা প্রধান সেনাপতী মীর জাফর বললেন। তারপরের পরিণতি আমরা সবাই জানি কিন্তু যেটি নবাব সিরাজউদ্দৌলা জানতে পারেননি তা হলো আমাদের পরবর্তী ২০০ বছরের বৃটিশ গোলামী এবং নবাব পরিবারের করুন পরিনতি। অন্যদিকে মীর জাফর এবং তার পরিবারের অবস্থার পরিনতিও কিন্তু করুন ছিলো। নেতৃত্বেরর বিষয়ে লিখতে গেলেই যে দুটি শব্দ আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আসে তা হলো আবেগ এবং এটাকে নিয়ন্ত্রণ করবার দক্ষতা। একসাথে বললে আবেগীয়-দক্ষতা। আমি খুব কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করে লেখাটিকে কঠিন করবার চেষ্টা করবো না আমার পাঠকদের জন্য। আবেগীয়-দক্ষতা বলতে আমি যা বুঝেছি ”নিজের আবেগকে বুঝে তারপর নিয়ন্ত্রন করে অন্যের আবেগের ভাষাকে নিজের জন্য অনুবাদ করা যা আমাকে সিদ্ধান্ত গ্রহনে সাহায্য করবে।
আমরা যদি বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্রের দিকে নজর দেই তাহলে দেখবো এখানে অনেক মানুষ আছেন যারা আবেগীয়-দক্ষতার মাধ্যমে নিজেদের প্রতিষ্ঠান, সংগঠন বা দলকে শক্ত হাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আবার এর ব্যতিক্রমও আমরা দেখতে পাই যেখানে আবেগীয়-দক্ষতার অভাবে নেতৃত্বের স্থানে বসেও সঠিক নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। নেতৃত্বের আসনে আসীন হওয়ার অর্থ হলো আপনাকে কয়েকটি বিষয়ে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে যেমনঃ
- সঠিক স্থানে সঠিক ব্যক্তিকে নির্ধারন করা।
- কাজকে বিভিন্নভাগে ভেঙে ফেলা।
- সঠিক ব্যক্তিকে কাজটি বা কাজগুলি বুঝিয়ে দেয়া।
- সঠিক সময়ে কাজ ডেলিগেট করা।
- কাজের অগ্রগতি অনুসরণ করা।
- প্রতি মুহুর্তে কাজের অগ্রগতি নিরীক্ষণ করা।
- সঠিক সময়ে কাজটি বা কাজগুলি বুঝে নেয়া।
- সঠিক সময়ে কাজ এবং কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মূল্যায়ন করা।
- কাজের মূল্যায়নের ভিত্তিতে মতামত প্রদান করা।
- দলের ভেতর সমন্বয় সাধন করা এবং কোন সমস্যা পরিলক্ষিত হলে সেটা আগেই চিহ্নিত করা এবং তাৎক্ষণিকভাবে সমস্যার সমাধান করা।
- ভবিষ্যতকে বর্তমানে বসে পর্যালোচনা করা এবং সেই মতে সকলের সাথে আলোচনা করা।
- কেউ পিছিয়ে পড়লে তাকে টেনে তুলে ধরে সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা দেয়া।
উপরের যে কাজ গুলোর কথা বলা হলো তার বাইরেও আরো অনেক কাজ একজন লীডারকে করতে হয়। এক কথায় নেতৃত্ব মানেই সিদ্ধান্ত গ্রহন। আসলে লীডার মূলত অভিভাবকের মতো প্রতিষ্ঠান, সংগঠন বা দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। আমার মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো লীডারকে প্রচুর পরিমানে শুনতে হয় সকলের কথা সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য। যে কেউ যে কোন সময়ে যোগ্যতার ভিত্তিতে অথবা কোন একটি ক্যারিশম্যাটিক গুণের কারনে নেতৃত্বের আসনে উপবিষ্ট হতে পারেন। তখনই আসলে প্রকৃতপক্ষে আবেগী-দক্ষতার বিষয়টি সামনে চলে আসে। আবেগী-দক্ষতার অভাবে উপরের যে কাজগুলোর কথা বললাম এবং শেষের দিকে শ্রবন করবার জন্য যে ধৈর্যের প্রয়োজন সেটা ব্যহত হয়। তখনই আমরা পক্ষপাতদুষ্ট নেতৃত্বের সাথে পরিচিত হই।
নেতৃত্বের নেতিবাচক পক্ষপাতিত্ব প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মীদের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ। অধিকাংশ সময় লীডার বুঝতেই পারেন না যে তিনি নেতিবাচক পক্ষপাতিত্বের স্বীকারে পরিনত হচ্ছেন। পক্ষপাতিত্বের বিষয়ে সচেতনতা একজন লীডারের জন্য অত্যন্ত জরুরী। অন্যথায় প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মাঝে
- সম্পর্কের অবনতি ঘটে,
- অবিশ্বাস জন্ম নেয়,
- অনমনীয়তা বৃদ্ধি পায়,
- কাজের ভেতর স্থিরতা চলে আসে,
- অসন্তোষ সহ আরো বিভিন্ন বিষয় দেখা দেয়।
নিরপেক্ষতা বলে কিছু নেই তবে পক্ষপাতিত্ব সম্পর্কে সচেতনতা একজন লীডারকে সাহায্য করে যোগ্যকে যোগ্যতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে। আবেগীয় দক্ষতাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারলে নেতৃত্বের দুর্বলতাকে অন্য কেই ব্যবহার করতে পারবে না। প্রত্যেক লীডার যদি আবেগীয় দক্ষতাকে প্রকৃতভাবে অনুশীলন করতে পারে এবং নেতিবাচক পক্ষপাতিত্বের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারে তাহলেই কর্মক্ষেত্রে
- বিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে,
- কর্মীদের মাঝে সহযোগিতা বেড়ে যাবে,
- নমনীয়তা পরিলক্ষীত হবে,
- প্রগতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে,
- কর্মীদের টার্নওভার কমে যাবে,
- উদ্ভাবন এবং সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পাবে,
- কর্মীদের মাঝে অভিযোগ কমে যাবে, যার ফলে গ্রাহক সন্তুষ্টিও বৃদ্ধি পাবে।
লীডারশীপের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মূল্যায়ন এবং এর উপরই নির্ভর করে অগ্রগতি। কিন্তু আবেগীয় দক্ষতার অভাবে নেতিবাচক পক্ষপাতিত্বের স্বীকার হয়ে যেটা যেভাবে দেখার কথা সেটা সেভাবে না দেখে অন্যভাবে দেখা শুরু হয়। সমস্যাটা হয় এখানেই। আমি কতটুকু বোঝাতে পেরেছি আমার এই ব্লগ থেকে সেটি বলতে পারবো না তবে নেতিবাচক পক্ষপাতিত্ব থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে। না হলে সঠিকভাবে মূল্যায়ন কোনভাবেই সম্ভব হবে না।
লেখকঃ
কে এম হাসান রিপন,
নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউট
Add a Comment