ফয়সাল ছোট বেলায় সবসময় বলতো, আমি অনেক জ্ঞানী এবং আমি অনেক কিছু জানি। যখন বড় হলো তখন তার এক বন্ধু তাকে প্রশ্ন করলো, তোমার জ্ঞানের ওজন কতো? উত্তর দিলো ১০ কেজি! পাল্টা প্রশ্ন এলো, মাত্র? আমার তো ২০ কেজি! আসলে ওরা দুজনই জানে না আসলে কার ওজন কতো। সমাজে আমরা প্রায়ই দেখতে পাই জ্ঞানী লোকের জ্ঞান বিতরণের চিত্র।
আবার যিনি বিতরণ করছেন তিনি আবার প্রতিযোগিতার মধ্যে চলে আসেন যখন আরেকজন জ্ঞানী ব্যক্তি তাকে প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দেন। তখন তৃতীয় জনের আবির্ভাব ঘটে। আর এভাবেই চলে জ্ঞান বিতরণে জ্ঞানী ব্যক্তিদের লড়াই। ঠিক এই মুহূর্তে আমি লিখছি আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা থেকে, কাল যখন প্রকাশ পাবে তখন হয়তো আরেকজন জ্ঞানী মানুষ আমাকে ফেলে দেবে তার ব্যক্তিগত জ্ঞান নির্ভর প্রশ্ন দ্বারা। জ্ঞানীর সাথে জ্ঞানীর লড়াই চলছেই যুগ যুগ ধরে।
অপর দিকে রিংকু ছোটবেলা থেকেই বলতো, আমি না একটা বল ছুড়ে ওই পাঁচতলার ছাদে পাঠাতে পারি। তার বন্ধু রাশেদ পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলতো আমি ছয় তলায় পাঠাতে পারি। অফিসে করিম সাহেব গেছেন ইন্টারভিউ দিতে। তার হবু বসকে তিনি বললেন, আমি মিনিটে ৩০টি শব্দ টাইপ করতে পারি। বস বললেন, আমাদের দরকার যিনি মিনিটে ৪০টি শব্দ লিখতে পারেন। আসলে যেখানে দক্ষতা যাচাইয়ের প্রশ্ন সেখানে আসলে তথাকথিত লড়াই করা যায় না।
উপরের যে দুটো দিক তুলে ধরা হলো তার প্রথমটি হচ্ছে জ্ঞান বা নলেজ, যা পরিমাপযোগ্য নয়। কারণ এর নির্দিষ্ট কোন সীমানা নেই, বিশাল সমুদ্রতুল্য। ৫০০০ হাজার বছর পূর্বেও মানুষের জ্ঞান ছিল যা তারা তাদের পূর্ববর্তীদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে নিজেদের জ্ঞানের সাথে মিশ্রণ ঘটিয়ে নতুন জ্ঞানের জন্ম দিয়েছেন। নতুনকে আমরা সহজে মানতে পারি না। এটা মানুষের স্বভাবসুলভ আচরণ।
আর যদি সেটা শুধুই জ্ঞাননির্ভর নতুন তত্ত্ব হয় তাহলে তো কথাই নেই, অনেক সময় নিয়ে নেয় মেনে নিতে। হয়তো এই মুহূর্তে কেউ নতুন তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছেন; পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে যা আমরা এই মুহূর্তে হয়তো মানবো না। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে দক্ষতা যা আমার মতে পরিমাপযোগ্য। পরিমাপযোগ্য বলছি এই কারণে যে, আমরা জানি এবং আমাদের মানতে সহজ। কারণ দক্ষতার সাথে পরিমাপযোগ্য উপাদান জড়িত।
একটি হোটেলে যখন ওয়েটার নিয়োগ দেয়া হয় তখন দেখা হয় দু-হাতে তিনি কতগুলো অর্ডার নিয়ে পরিবেশন করছেন কোন প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি ছাড়া। যখন গ্রাফিক্স ডিজাইনার নিয়োগের প্রশ্ন আসে তখন দেখা হয় একটি কনসেপ্টকে ডিজাইনে আনতে কতো সময় নিচ্ছেন যা পরে মিলিয়ে দেখা হয় সেই প্রতিষ্ঠানের স্ট্যান্ডার্ডের সাথে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিন্তু দক্ষতা নির্দিষ্ট উপাদান দ্বারা পরিমাপ করা যায় এবং করা হয়।
জ্ঞান নির্ভর সমাজ আমরা সবাই চাই কিন্তু শুধু জ্ঞান দিয়ে তো সমাজের আসল চিত্র পরিমাপ করা যাবে না। যেমন, বিদেশে আমাদের দক্ষ শ্রমিক ভাইয়েরা যাচ্ছেন, কাজ করছেন, অর্থ উপার্জন করছেন এবং আমাদের দেশে পাঠাচ্ছেন। ধরা যাক, আমরা দক্ষ না করে শুধু জ্ঞান দিয়ে তাদের বিদেশে পাঠালাম এবং অপরিমাপযোগ্য জ্ঞানের কারণে তারা ফেরত চলে আসল, তাহলে আমাদের দেশের চিত্র বিদেশে কেমন হতো?
আমাদের সম্পর্কে ধারণা হতো আমরা কথায় বড় কাজে ঠন ঠন। কদর সেই ব্যক্তির যিনি কথায় অল্প পটু হলেও কাজে সাংঘাতিকভাবে পরিমেয়। এখনকার সমাজ বা প্রতিষ্ঠান কী চায়? আমাদের যেমন জ্ঞান থাকা চাই, তেমনি কোন একটি বিষয়ে আমাদের মাস্টার হতে হবেই, মানে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় আমাদের দক্ষতা নিশ্চিত করা। কারণ দক্ষতা ছাড়া আমার জ্ঞান আমি পরিমাপ করাতে পারবো না।
সাধারণত কোন একটি বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজন মনোযোগ সহকারে পড়া বা পড়ানো, দেখা বা দেখানো এবং শোনা বা শোনানো। কিন্তু দক্ষতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন করা বা করানো এবং পর্যাপ্ত অনুশীলন। আমি কতো জ্ঞানী সেটাও অনেকক্ষেত্রে লিখে বা বলে মাপানো যায় কিন্তু দক্ষতা একমাত্র করে দেখাতে হয়। দক্ষতা নির্ভর সমাজ প্রতিষ্ঠায় অবশ্যই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আনতে হবে আমূল পরিবর্তন। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় থাকতে হবে হাতে কলমের শিক্ষা।
সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা বেরিয়েই বলছে ‘আমি জানি কিন্তু পারি না’! আর উন্নত দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা বেরিয়েই বলছে ‘আমি জানি এবং পারি’ পার্থক্যটা এখানেই। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা অধিকাংশ ক্ষেত্রে লেখা বা বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। করে দেখানোর মতো সাহসিকতা না ছাত্ররা দেখায় না শিক্ষকরা। এই সাহসিকতা যতদিন আমরা দেখাতে না পারবো ততদিন আমরা শুধু কথাতেই বড় হয়ে থাকবো। আর আমরা তো জানি মর্যাদা তাদের বেশি যারা কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হয়।